রাজধানীসহ সারাদেশে গণপরিবহনে যাত্রাপথে নারীরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে মানসিক ও শারীরিক ‘নীরব যুদ্ধ’ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কিন্তু কোনো ধরনের প্রতিকার পাচ্ছেন না নারীরা। বাংলাদেশ রোড সেফটি নেটওয়ার্ক এবং বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন একাধিক সমীক্ষা পরিচালনা করে। এতে দেখা যায়, দেশের গণপরিবহনে যাতায়াতকারী নারীদের ৮৩ শতাংশ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন।
জানা গেছে, কর্মস্থল কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে গণপরিবহনই নারীদের একমাত্র ভরসা। কিন্তু যাত্রাপথে তাদের নিরাপত্তাহীনতা যেন দিন দিন আরও স্পষ্ট হচ্ছে। নির্ধারিত আসনের নিয়ম না মানা থেকে শুরু করে নিত্যদিনের মানসিক ও শারীরিক হয়রানি নারীদের যাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলছে। প্রতিদিন গণপরিবহনে যাত্রা যেন নারীদের জন্য এক নীরব যুদ্ধ। শুধু গন্তব্যে পৌঁছানোর নয়, এ যুদ্ধ নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতেরও। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় গণপরিবহনের ওপর নির্ভরশীল এ দেশের অধিকাংশ নারী ঠিক কতটা নিরাপদে পৌঁছান তার গন্তব্যে। রাজধানীর বাড্ডা থেকে পুরান ঢাকার সদরঘাটে আসার উদ্দেশে ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের একটি বাসে উঠেছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী অনিমা। বাসে আসন ফাঁকা না থাকায় গুলিস্তান পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অনিমাকে। এ সময়ের মধ্যে যৌন হয়রানির তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন তিনি। তবে এবারই প্রথম নয়, এর আগে বই কিনতে নীলক্ষেত যাওয়ার সময়ও যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তাকে। তার কথায় ওঠে আসে রাজধানীর গণপরিবহনে নারী যাত্রীদের নানা অসুবিধা ও নজেহাল হওয়ার কথা। কবি নজরুল কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী তাহমিনা আক্তার বলেন, আমার বাসা শান্তিনগর। সপ্তাহে ন্যূনতম তিন থেকে চার দিন কলেজে যেতে হয়। আমার মতো আরো শত শত ছাত্রী আছে নিয়মিত কলেজে যাতায়াত করে। আমি বা আমার মতো নারী শিক্ষার্থীরা পাবলিক বাসে চলাচল করে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছি। নারীদের জন্য যদি আলাদা বাস সার্ভিস চালু হয় তাহলে আমার মতো অসংখ্য নারীকে পাবলিক বাসে যে হয়রানির শিকার হতে হয় তা থেকে রক্ষা পাব। শিক্ষার্থী তাহমিনা আক্তারের মতো গণপরিবহনে যাতায়াত করেন সূচনা আক্তার (৩২) নামের একজন নার্স। তিনি বলেন, আমার কর্মস্থল রাজধানীর কলাবাগানে। আমি একটা বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করি। চাকরির সুবাদে আমাকে সপ্তাহে ছয়দিন বাসে চলাচল করতে হয়। বাসে চলাচল করার সময় অসংখ্যবার আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছি। চাকরি যেহেতু করি সেক্ষেত্রে বাসে যাতায়াত করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। সেক্ষেত্রে যদি নারীদের জন্য কোনো স্পেশাল বাস সার্ভিস চালু হয় তাহলে অন্ততপক্ষে হয়রানি থেকে রেহাই পাব। শুধু অনিমাই কিংবা তাহমিনা আক্তারই নয়, তারমতো অসংখ্য নারীকে গণপরিবহনে চলাচলের সময় প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। হাতেগোনা দু-একজন প্রতিবাদ করলেও বাকিরা ভয় বা লজ্জায় কিংবা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ার আশঙ্কায় প্রতিবাদ এড়িয়ে চলেন।
বাংলাদেশ রোড সেফটি নেটওয়ার্কের এক জরিপ বলছে, দেশের গণপরিবহমে যাতায়াতকারীদের মধ্যে ৮৩ শতাংশ নারী প্রতিদিন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। যদিও সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ অনুযায়ী, প্রতিটি বাসে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ৯টি আসন সংরক্ষিত রাখার কথা। কিন্তু সড়ক ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ বাসে এ নিয়ম উধাও। কাগজে-কলমে নিয়ম থাকলেও এর বাস্তবায়ন না থাকায় মাঝে মধ্যেই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে বলে জানান পুরুষ যাত্রীরা। তারা বলছেন, মাঝেমধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়ত অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে। কিন্তু বেশিরভাগই নারীদের সিটে পুরুষ বসেন না। বরং নারীরা পুরুষের সিটে এসে বসেন। নিরাপদ যাত্রায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীতে চালু করা হয় কাউন্টারভিত্তিক বাস পরিঘেবা, যেখানে শুধু নারীর জন্যই ২১টি কোম্পানির ২ হাজার ৬১০টি গোলাপি রঙের বাস যাত্রা শুরু করলেও মুখ থুবড়ে পড়েছে সেই প্রকল্পও। তবে এ বিষয়ে মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের দায়িত্বরতরা এড়িয়ে যান। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরিতে মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজন সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণমূলক ভূমিকা।
দেশের নগর গণপরিবহনে যাতায়াতকারী নারীদের ৮৩ শতাংশ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। নগর গণপরিবহন কোনোভাবেই নারীবান্ধব নয়। বাসগুলো কাঠামোগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ। এছাড়া বর্তমানে দেশে ৫ লাখেরও বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন রয়েছে, যার ৭০ শতাংশ সড়কে চলাচল করছে। এসব যানবাহনের মধ্যে পণ্যবাহী যানবাহনের সংখ্যা ৭৫ হাজার। রাজধানী ঢাকায় ১০ হাজারের বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন চলছে। অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য এসব যানবাহন দায়ী। এ তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ রোড সেফটি নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক পাহাড়ি ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘ ৫৪ বছরেও টেকসই পরিবহন কৌশল বাস্তবায়ন না করার কারণে সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গড়ে ওঠেনি নিরাপদ জনবান্ধব গণপরিবহন ব্যবস্থা। দুর্বল ও অপ্রতুল সড়ক অবকাঠামো, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের অসচেতনতার কারণে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইভাবে অনলাইন মাধ্যম অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চেয়ে গণপরিবহনে নারীরা বেশি যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে একটি বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষায় উঠে এসেছে। সমীক্ষাটি পরিচালনা করেছে বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন। সম্প্রতি জুমের ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘তরুণীদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব’ শীর্ষক সমীক্ষাটির তথ্য প্রকাশ করেছে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনটি।
এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী খুশি কবির বলেন, নারীকে যতক্ষণ পর্যন্ত এ দেশের নাগরিক হিসেবে সমান মর্যাদা ও অধিকার দেয়ার বিষয়ে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত যতই আইন করা হোক, এমন হয়রানি চলতেই থাকবে। একই সুরে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওশন খান। তিনি বলেন, নারীদের জন্য ঢাকা শহরে বিপুল সংখ্যক আলাদা বাস দেয়া দরকার। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কেন আলাদা বাস দিতে হবে, সারাক্ষণ তো বলা হচ্ছে সমঅধিকারের কথা। কিন্তু সমঅধিকার আর পাবলিক প্লেসে হ্যারাসমেন্ট হওয়ার বিষয়টা ভিন্ন জিনিস। সমাজের সব শ্রেণির মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনের ওপরও জোর দেন এই বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা দিপ্ত ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক জাকিয়া কে হাসান বলেন, গণপরিবহনে নারীদের হয়রানি নিত্যনতুন ঘটনা না। যতই উদ্যোগ নেওয়া হয় না কেন, তা তেমন কোনো কাজে আসে না। তবে এক্ষেত্রে ইউনিক কিছু চিন্তা ভাবনা করতে হবে। এর আগে শহরের ১০০ বাসে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছিল রাজধানীর প্রত্যেকটা বাসে যদি ক্যামেরা স্থাপন করা যায় তাহলে কিছুটা হলেও হয়রানি কমবে বলে মনে করেন তিনি। আঁচল ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সামিরা আক্তার বলেন, গণপরিবহনে হয়রানি বন্ধে আমাদের দশটি নির্দিষ্ট প্রস্তাবনা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা। দেখা যায়, অনেক সময় তাড়াহুড়া বা সময়ের অভাবে বা বাড়তি ঝামেলা মনে করে অনেকে এসব এড়িয়ে যান। সেক্ষেত্রে যদি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মধ্যে দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে এর শাস্তি নিশ্চিত করা যেত তাহলে বেশ ভালো হতো। তিনি আরো বলেন, গণপরিবহনে হয়রানি বন্ধে আমাদের আরো বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা ছিল। সেগুলো হলো, পরিবহনে আসনের বেশি যাত্রী না তোলা, বাসের চালক, তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারীর পরিচয় উল্লেখ করে নেমপ্লেট বাধ্যতামূলক করা ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো গণপরিবহনের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে বাধ্যতামূলক করা হলে এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে আইনি ব্যবস্থা নিলে কিছুটা হলেও নিরাপত্তা নিশ্চিত হতো।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
* মানসিক ও শারীরিক হয়রানি আরও কঠিন করছে নারীর যাত্রা * গণপরিবহনে যাতায়াতকারী নারীদের ৮৩ শতাংশ নির্যাতনের শিকার
গণপরিবহনে যাত্রাপথে নারীদের নীরব যুদ্ধ
- আপলোড সময় : ০২-১২-২০২৫ ১১:০৭:৩০ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০২-১২-২০২৫ ১১:০৭:৩০ অপরাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
স্টাফ রিপোর্টার